অনেক দিন ধরেই ভাবছিলাম কোথাও ঘুরে আসি। দেশের ভেতর ই কোন শহর, বন্দর কিংবা অন্যরকম কোনো লোকালয়। তবে প্রথম পছন্দের ছিলো শ্রীমংগল চা বাগান। দেখা গেল সময় হলো তো সাথী পাই না, আর সাথী পাইলে সময় হয়না।সংগীহীন ভ্রমণ কেবলই নিরানন্দ নিরামিষ। কারো সাথে কথা না বলতে পারার বোর লাগে তাতে চোখ জুড়ায় মন ভরায় না। তাই হঠাত বিরিশিরি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাকে তৈরী থাকতে বলায় রাজি হয়ে গেলাম।
সকাল সকাল রওনা দিলাম সংগী পাচজন তাদের হায়েস মাক্রো নিয়ে। অনেক দিন পর ঘড় থেকে দু'পা বাহিরে রাখলাম। ভালোই লাগছে। সবই আমার কাছে অচেনা অজানা মনে হচ্ছে।মেট্রোরেল, হাইওয়ে, ওভার পাস আন্ডার পাস,এলিভেটর এক্সপ্রেস ওয়ে, জীবনের শেষ বয়সে এনালগ মানুষ একা একা চললে নিঘা'ত পথ হারাবো গোলকধাঁধায় তাতে কোনো সন্দেহ নাই।
গাজীপুরের আগেই গাড়ির বন্ধ হয়ে গেলে লম্বা সফরে মনে শংকা ঢুকিয়ে দিলো।সবাই মিলে ঠেলে গাড়ি রাস্তার পাশে নিলাম। মিস্ত্রির সাথে কথা বলে বেশ বিলম্বে গাড়ি ষ্ট্রাট' করা গেলো।রাস্তা ফাকা ভালো ই চলছিল গাড়ি। গাজিপুর পার হয়ে নাস্তা খেতে রেষ্টুরেন্টে ঢুকলাম অডা'র দিয়ে বসেছি ড্রাইভার এসে জানালো স্যার গাড়ি আবার ষ্ট্রাট' নিচ্ছে না। ওয়েটার এসে জানালো সব শেষ একটু দেরি হবে। রেষ্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে পড়লাম। গাড়ির চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে। এবার ও মিস্ত্রির সাথে কথা বাতা' বলে গাড়ি ষ্ট্রাট' করা গেলো। নাস্তা আর খেলাম না, সামনে এগোতে লাগলাম। ভাওয়াল জাতীয় উদ্দ্যানে এসে আবার গাড়ী বন্ধ। অনেক খোজাখুজির পর মিস্ত্রি পাওয়া গেলে আবার ঠিক করে সামনে চলা। খাওয়া দাওয়া বন্ধ। ভ্রমণ আনন্দ আর আসছিল না মনে।
যান্ত্রিক ত্রুটিতেই মন খারাপ সামনে আরও যে ভয়াবহ অবস্থা অপেক্ষা করছে জানা ছিল না।সমস্যার কারণে গাড়ির গতি ও বাড়ানো যাচ্ছিলো না।ত্রিশাল, ভালুকা পার হলাম। ময়মনসিংহ দিয়ে দুগা'পুর রাস্তায় ঢুকতে-ই খানাখন্দ আরম্ভ। যতই সামনে এগোতে লাগলাম কাদা বালি পানিতে একাকার বিশাল বিশাল খানাখন্দ বাড়তে লাগলো। এক একটা খানাখন্দ পার হতে গাড়ির বডি নিচে বেধে যাওয়ার শব্দে দম বন্ধের অবস্থা না জানি আবার ষ্ট্রাট' বন্ধ হয়ে যায়। ষ্ট্রাট' বন্ধ হ'লে সহজে পার পাওয়ার সম্ভাবনা নাই। আমাদের সবার মাঝে নিস্তব্ধতা। পুরো রাস্তা বালুর ট্রাকের দখলে কোনো সিগনাল ই তারা মানতে নারাজ। ডিপার দিলে উল্টো তারা ডিপার দিতে দিতে একেবারে সামনে হাজির।ভাবখানা এমন তাদের রাজত্বে আমরা আবার কোথা থেকে এলাম।সারা রাস্তায় বালির ট্রাকের মাঝে আমাদের একমাত্র গাড়ি বড়ই বেমানান লাগছিল।তাতে বুঝলাম একটা ভুল হয়ে গেছে এপথে এসে। নিচে বেধে যাওয়ায় গাড়ি থেকে নামতে ও হলো।এলাকার জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন আছে ব'লে মনে হয় না। মানুষকে মনে হলো ভাবলেশহীন এতে ই তারা অভ্যস্ত। প্রতিকার কিংবা প্রতিবাদের কিছুই নাই তাদের। জিম্মি তারা বালুখেকো ব্যবসায়ীদের কাছে।
নদীর পাড়ে যখন পৌছালাম তখন চারটা বাজার কাছাকাছি। নদীর কোনো সৌন্দয্য'ই আর অবশিষ্ট নাই। ড্রেজিং মেশিনে বালি তুলে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলা হয়েছে। সম্ভবত এটাই দুগা'পুর।যাত্রার কষ্ট আর আতংকে কোনো কিছু জানা বা ভ্রমণের ছবি তোলার কথাও সবাই ভুলে গেছে। আগে খেতে হবে। গাড়ি বালুমহালে একপাশে রেখে সবাই বেরিয়ে পড়লাম।একটা হোটেল পেলাম কোনো কিছু চিন্তা না করে বসে গেলাম। একজন তৃতীয় লিংগের মাঝ বয়সী মানুষ কতো সুন্দর ভাবে কাস্টমার তদারকি, খাবার পরিবেশন ঠিক মতো হচ্ছে কিনা তার তদারকি, বিল কালেকশন সবই খুব সুন্দর ভাবে খুবই ভদ্রভাবে ই সম্পন্ন করছেন। খাবার খেতে খেতে তাকে বারবার দেখছিলাম আর আমাদের ঢাকা শহরে তাদেরই কারো কারো মাস্তানী আর চাদাবাজীর তুলনা করছিলাম। নদীর পাড়ে আসতেই পাচটা বাজে। নৌকায় নদী পার হয়ে গেলাম বিরিশিরি চিনামাটির পাহাড় দেখতে। গেলাম নেত্রকোনার বিজয়পুর আমাদের বিজিবি চেকপোস্ট দেখতে। পাচটা বেজে যাওয়ায় গেট বন্ধ।জিরো পয়েন্ট দেখা হলো না।পাশ দিয়ে গেলাম সোমেশ্বরী নদী দেখতে। ওপারে দূরে দেখা মেলে মেঘালয় এর গারো পাহাড়। সন্ধ্যা হয়ে গেছে । এতো দীর্ঘ কষ্টকর পথ পাড়ি দিয়ে অনেক কিছু দেখার থাকলেও কিছুই দেখা হলো না ।
এবার ফেরার পালা তবে অবশ্যই বিকল্প ভাবনা।কোনো ভাবে রাতে আসার পথে ফেরা যাবে না। নদীর এপারে এসে দুচার জনের সাথে আলাপ করে যাত্রা শুরু নাসিরপুর,আনন্দপুর সিধলীর পথে।যতই রাত বাড়ছে চারিদিকে পাল্লা দিয়ে অন্ধকারও বাড়ছে। রাস্তার অবস্থা একই, পাথ'ক্য এপথে বালির ট্রাক নাই। কিছদুর পরপর খানাখন্দ, ছোট ছোট ব্রিজের মুখে কাদাপানিতে একাকার গত' গাড়ি পার হওয়া বড়ই কষ্টকর।প্রায় জনমানবহীন রাস্তায় দু'একটা মটর সাইকেল আর টুক-টুকি ছাড়া কিছুই নাই।কংগসো নদীর কেবলই নাম দেখলাম। আরও হয়তো ছিলো অনেক কিছু দেখার কিন্তু অন্ধকারে কিছুই দেখা হলো না। সিধলী-নেত্রকোনা হয়ে ঢাকার বাসায় যখন ফিরলাম তখন ঘড়ির কাটা দুইটার ঘরে। এভাবে ১৯ ঘন্টার প্রায় ৫০০ শত কিলোমিটার এর নিষ্ফল বেদনাদায়ক ভ্রমণের পরিসমাপ্তি ঘটলো। রাজধানীর মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার, আন্ডারপাস হাইওয়ে, এলিভেটর এক্সপ্রেস ওয়ের সুবিধায় থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশ এর কোনও জেলার পাকা-সড়কে এমন পানি কাদায় মাখামাখি খানাখন্দ থাকতে পারে, সেখান মানুষ জন এক দুবি'সহ জীবন যাপিত করতে পারে তা জানা হতো না। আবার যদি কখনো যাওয়া হয় বিরিশিরি দেখতে অবশ্য ই ময়মনসিংহ -দুগা'পুর পথে নয় ভাবতে হবে বিকল্প অন্য কোনো পথে।
No comments:
Post a Comment
Note: Only a member of this blog may post a comment.